শিল্পীরা দলে ভিড়ি কেন?
বাংলাদেশের চার তরুণ শিল্পী একটা দলীয় প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। অস্পৃশ্য আলোময়তা এই প্রদর্শনীর স্থান। দলীয় এই প্রদর্শনীটি তাদের ওয়েবসাইটে দেখার পর তাদের সাথে কথা হয় জুমে। শারীরিকভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা যখন কাম্য করোনা থেকে বাঁচার তাগিদে, আবার ঐক্য যখন সমষ্টিগত অধিকার আদায়ের একমাত্র শর্ত, তখন ভাবনায় দৃঢ় এই চার তরুণ কেন এবং কীভাবে দল তৈরি করছেন আর তাদের শিল্পের ভাষা ও প্রকাশের স্থান কীভাবে নির্বাচিত হয়েছে তা নিয়েই মূলত আলাপ। আলাপ থেকে মূলত বুঝতে চেয়েছি কেন তারা একটি দলীয় প্রদর্শনীর প্রয়োজন অনুভব করলেন? যখন অন্যান্য অনেক দলীয় প্রদর্শনী চলছে বা আগেও হয়েছে, সেখান থেকে তারা কেন ভিন্ন? কেন জরুরি আরেকটা নতুন মঞ্চ? তাদের সাথে আলাপে ঢোকার আগে এ দেশে দলীয় শিল্পচর্চার পটভূমিতে একটু হেঁটে আসতে চাই।
স্থান, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, বর্তমানে যার নাম মৌলানা আজাদ কলেজ। সাল, ১৯৪৬। এই কলেজ থেকেই বঙ্গবন্ধু স্নাতক পাস করেন। পাকিস্তান পর্বে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পটভূমি বুঝতে এই তথ্যটি এখানে সংযুক্ত হলো। এই প্রদর্শনী নিয়ে বিস্তারিত অন্য জায়গায় বলব।
ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম একদল তরুণ ব্যস্ত তাদের শিল্পকর্ম সাজাতে। প্রদর্শনী স্থলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের পথিকৃৎ শিল্পীদেরকে। যারা পরবর্তীকালের বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাসের নিয়ন্তা। এই দলবদ্ধ প্রদর্শনীকে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে প্রথম দলীয় প্রদর্শনী বলা যায়, যা বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনেরও সূচনা করে। এমন দৃঢ় রাজনৈতিক শিল্প আন্দোলন বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাসে নেই বললেই চলে। সত্তরের দশক বা আশির দশকেও রাজনৈতিক ইশতেহারকে শিল্পের ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করে যারা শিল্পকে গণভাষায় রূপান্তরিত করেছেন, তাদের শিল্প আন্দোলন থেকে ইসলামিয়া কলেজের প্রদর্শনীটি এক ও ভিন্ন। এক এই অর্থে যে, তৎকালীন রাজনৈতিক ইশতেহারকেই এই প্রদর্শনীটির শিল্পীরা নিজেদের সংগঠিত হওয়ার কারণ, তথা ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে মুসলিম হিসেবে ভিন্ন ভূ-খন্ডের পরিচিতির দাবিটিই এখানে মৌলিক ভাষ্য। ভিন্ন এই অর্থে যে, এই দাবিটিকে শিল্পের বিষয় হিসেবে নিয়ে ছবি আঁকা হয়নি, প্রত্যেকেই নিজ নিজ একাডেমিক কাজ নিয়েই এতে অংশগ্রহণ করেছেন। তাই ইসলামিয়া কলেজের দলীয় এই প্রদর্শনীটিকে যথাযথ পাঠ করলে আমরা কতগুলো সুস্পষ্ট লক্ষ্য তাদের সামনে দেখতে পাই-
১। আত্মপরিচয়ের সংকট ও তার সমাধান খোঁজা
২। বিচ্ছিন্নতাকে দুর্বলতা হিসেবে শনাক্ত করতে পারা এবং এক হওয়া
৩। শিল্পী হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতাকে শনাক্ত করা এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে স্থান নির্বাচন
এরপর দ্বিতীয় দলীয় প্রদর্শনীর দেখা আমরা পাই ১৯৫১ সালে-‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’ শিরোনামে। তুলনামূলকভাবে এই প্রদর্শনীর সামনে প্রধান লক্ষ্য হতে দেখি-আধুনিক শিল্পের সাথে পূর্ব বাংলার মানুষকে পরিচয় করানো এবং আধুনিক শিল্পের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে ইসলামিক রাষ্ট্রে শিল্পের জন্য জায়গা করে নেওয়া। এই লক্ষ্যগুলোকে খুব বেশি নতুন বলা যায় না, ঢাকায় শিল্পবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সাথে তুলনা করলে। বরং সহজে বলা যায়, শিল্পবিদ্যালয়ের লক্ষ্যের সম্প্রসারণ ঘটাতেই ঢাকা আর্ট গ্রুপের জন্ম।
এই দুটি দলীয় প্রদর্শনীর প্রবণতাগুলো একবার দেখে নিতে চাই। প্রথম দলীয় প্রদর্শনীতে শিল্পীরা কলকাতায় একতাবদ্ধ হচ্ছেন মুসলিম পরিচয়ে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও শক্তির অনুসরণে। দ্বিতীয় প্রদর্শনীর লক্ষ্যের মধ্যে আমরা এই অঞ্চলে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে দুটি সংকটকে চিহ্নিত করতে পারছি-পাকিস্তান পর্বে লাহোরের বিপরীতে পূর্ব বাংলার রাজধানী তথা ক্ষমতার কেন্দ্র ঢাকাকেন্দ্রিক শিল্পচর্চাকে সীমায়িত করা এবং বাংলার মানুষকে শিল্প বিষয়ে নিরক্ষর হিসেবে চিহ্নিত করা। ফলে নিরক্ষরতা এবং ধর্মীয় রাজনীতি দুটি সংকট আধুনিক শিল্পচর্চার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল।
প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের শিক্ষায় শিক্ষিত এবং কলকাতা থেকে আসা বা কলকাতা ঘুরে আসা নাগরিক শিল্পীরা কী কী উপায়ে বাংলার মানুষকে শিল্প বিষয়ে অজ্ঞ বিবেচনা করলেন, তা বোঝার আগে বলতে হবে, তারা শিল্প বলতে কী শিখলেন?
তারা মূলত দুটি ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করলেন-খারাপ বা দুর্বল শিল্প এবং ভালো বা মহৎ শিল্প। মহৎ শিল্পের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা কলকাতা আর্ট কলেজে যে একাডেমিক পদ্ধতি আয়ত্ত করলেন, তাই। ফলে তারা একটা পদ্ধতিকেই একমাত্র শিল্পপদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করলেন। এই শিল্পপদ্ধতির অনুকরণেই ঢাকায় শিল্পবিদ্যালয় এবং এই বিদ্যালয় থেকে উৎপাদিত শিল্পীদলের দলীয় শিল্প প্রদর্শনী ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’। তাই বাংলায় যারা রাজধানী কলকাতা থেকে শিক্ষিত আধুনিক শিল্পী হিসেবে ফিরে আসলেন, তাদের সাথে বাংলার মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ধর্মীয় অবরোধের যে দাবি নানান সময়ে সামনে প্রধান হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে, তার চেয়ে বড় অবরোধ যে শিল্পীরা নিজেরাই আরোপ করলেন তা আমরা বুঝতে পারলাম না। ফলে নিরক্ষর বাঙালিকে শিক্ষিত শিল্পদর্শক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের মূল দাবি হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিল। নিরক্ষর বাঙালি যদি আধুনিক শিল্পীদের ভাষা পড়তে চায়, তাহলে তাকে কী কী করতে হবে?
১। দেয়ালে সাজানোর জন্য টাকার বিনিময়ে ছবি কিনতে শিখতে হবে।
২। এই ছবিকে অমরত্ব দান করতে জানতে হবে।
জীবন ও জীবিকার বাইরে শিল্পকে আলাদা করে দেখতে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী জানে না। এবং অমরত্ব ধারণার বিপরীতে তার পুরো জীবন দর্শন। ফলে আধুনিক নাগরিক শিক্ষিত শিল্পীরা সংস্কৃতির সেতু নির্মাণ করার বদলে তা ভেঙে ফেললেন। এই ভাঙা সেতুর এক পাশে বসেই শুরু হলো মান-অভিমান ও অভিযান। একাডেমিক রীতিটি এখানে সংকটের কারণ নয়; তাকে সুপিরিয়র হিসেবে দেখার পথটিই সংকটের কারণ। তাই দ্বিমাত্রিক স্থানিক শিল্পকে অস্বীকার করে পশ্চিমমুখে এবার নিজে নিজেই আমরা ছুটে চললাম। সেখানে গিয়ে যখন আবার দ্বিমাত্রিকতাকে আধুনিকতা হিসেবে জানার সুযোগ পেলাম, তখন বিচ্ছিন্ন শিল্পীরা হয়ে উঠলেন বিষয়হীন, ভাষাহীন। যদিও এই শিল্পীদের কাছে ইংরেজদের একাডেমিক পদ্ধতিটিই ছিল নতুন এবং আগ্রহ উদ্দীপক। কিন্তু আবারও কেন্দ্র ধারণার দাবানলে আধুনিক পশ্চিমী শিল্পের পিছে ধাওয়া করলেন তারা এবং বাংলাদেশের দলীয় শিল্পচর্চাও জন্ম নিল তারই অনুকরণে।
এই ধারাবাহিকতার ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শিল্প, উত্তর ঔপনিবেশিক শিল্প, শিল্পের বিউপনিবেশায়ন-এর মতো অনেক তত্ত্ব ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু তার কোনটিই অনুকরণ প্রবণতাকে অস্বীকার করে নয়। জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার, আর্ন্তজাকিতাবাদকে ব্যঙ্গ এবং বিশ্বায়নকে শিল্পের মুক্ত বাতায়ন হিসেবে দেখাটাই এই সময়ের শিল্পীদের প্রবণতা। এমন একটি পটভূমিতে বৈশ্বিক মহামারির অভিজ্ঞতা এ দেশেই যখন পাঁচ মাস চলছে, তখন এই দলীয় আয়োজন আমাদের কাছে কী অর্থ বহন করে? কেন এই প্রদর্শনীটির প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত অথবা কেন নয়? মনে রাখা ভালো, মহামারির অনেক আগেই ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞরা গ্লোবালাইজেশনকে স্লোবালাইজেশন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং একে একটি অকার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে শুরু করেছিলেন।
অস্পৃশ্য পরিসরে আয়োজিত ‘কিপিং আওয়ার হেড অ্যাবাভ ওয়াটার’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীর চার তরুণ শিল্পীর কাছে আমার প্রথম প্রশ্নটি ছি্ল-তারা কেন গ্রুপ তৈরি করেছেন?
গ্রুপের পক্ষ থেকে শিল্পী বজলুর রশীদ শাওন বলেন- ‘ক্যানভাসার’টা (গ্রুপ ওয়েবসাইট) হলো আমাদের মতো যারা নতুন একটু কাজ করতেছি, কাজে ইনভলভ হইতে চাই, এই ধরনের মানুষগুলার জন্য; যেন সহজে করোনা পরিস্থিতিতে বা করোনা পরিস্থিতি না থাকলেও, ভার্চ্যুয়াল গ্যালারির যে ট্রেন্ড, তার সংরক্ষণ কোয়ালিটি… এই বিবেচনায় এই এক্সিবিশন বা ক্যানভাসারটা করা। আর গ্রুপের ব্যাপারটা আসলে লাস্ট বছরখানেক বা তারও বেশি সময় ধরে এই আমাদের চারজন মানুষের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুব ভালো। সেই জায়গা থেকেই ক্যানভাসারের জন্য এই চারজন মানুষকেই প্রপোজ করা। প্যান্ডেমিকের মধ্যে যে আমরা নতুন বাস্তবতায় পৌঁছাইলাম, সেই বাস্তবতাটাকে রিড করা। পারটিকুলার এজেন্ডা নিয়ে কাজ করার চেয়ে পারসোনাল ক্রাইসিস নিয়ে কাজ করার চেষ্টা…’
কিন্তু তাদের প্রদর্শনীর কাজের ওপর যে টেক্সটটি তারা প্রকাশ করেছেন, তাতে একটি শক্তিশালী বক্তব্য আছে, যা সরাসরি বক্তব্যে নেই। সরাসরি যা উত্তর করছেন, তার সারাংশ দাঁড়াচ্ছে সময়ের সহজ প্রবণতার অংশ হিসেবে সহজলভ্য একটি পরিসরে নিজেদের প্রকাশ করা। এই প্রকাশ করাটাই এখানে মূখ্য বিষয়। এমন মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পী ধীমান জানতে চান, আমি কোন টেক্সটটি মূলত ফলো করেছি, বাংলা না ইংরেজি। বাংলা টেক্সটটি লিখেছেন শিল্পী ধীমান সরকার নিজে এবং ইংরেজি টেক্সটটি লিখেছেন শিল্পী অন্তরা দে। প্রশ্নটির মধ্য দিয়ে চার শিল্পীর ঐক্যের ধরন ও তার প্রকাশভঙ্গির সংকটটি প্রকাশ পায়।
শাওন বলেন, ‘আমরা যে টেক্সট দিয়েছি তাতে আমাদের পারসোনাল ক্রাইসিস এবং কালেক্টিভ ক্রাইসিস, যা আমরা বলতে চাই সেটা ওখানে আছে। নাম্বার টু হলো আমরা কোনও পার্টিকুলার এজেন্ডা নিয়ে নামি নাই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আমরা এইটা কন্টিনিউ করব। আমরা কোনও এজেন্ডা দিতে চাইও নাই। কারণ হচ্ছে যে, আমাদের এখানে যে প্র্যাকটিস চলছে, সেই প্র্যাকটিসে আমাদের খুব বেশি কোনও কন্ট্রিবিউশন নাই, কন্ট্রিবিউশন থাকতেই হবে তাও না। দুই হচ্ছে, এই ধরনের কোনও একটা অল্টারনেটিভ ঘোষণা দেওয়ার জন্য যে ধরনের বেইজমেন্ট নিয়ে নামা প্রয়োজন, আমরা যদি গ্রুপ হিসেবে পরে এইটা কন্টিনিউ করি, সেই ক্ষেত্রে আমরা আমাদের এজেন্ডাগুলো একটা একটা করে হাজির করব। যদিও আমাদের মধ্যে ইনিশিয়ালি এই ধরনের কোনও কথাবার্তা ডিরেক্ট হয় নাই। কিন্তু পাশাপাশি এইটাও কথা হইছে যে, না আমরা এইটা কন্টিনিউ করব।’
করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের শিল্পী ও শিল্প উদ্যোক্তারাও বাইরের নানা উদ্যোগের অনুকরণে নিজেদের শিল্পকর্ম প্রকাশের উদ্যোগ শুরু করেন। তার মধ্যে নিজেদের শিল্পকর্ম মনমতো অন্য শিল্পীকে ট্যাগ করে প্রকাশ করার রকমটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ইংরেজি টেক্সটটি বাদ দিয়ে বাংলায়ও যে নিজের বক্তব্য লিখতে পারেন, এইটুকু করতেও অনেকটা সময় পার করতে হয়েছে এবং কয়েকজন মাঝে মাঝে সাহসী হয়েছেন। নানা ধরনের শিল্প উদ্যোগ অস্পৃশ্য (ভার্চ্যুয়াল) পরিসরে দেখা দিতে শুরু করে এবং এখন বিষয়টি একটি সাধারণ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে বলা যায়। কিন্তু এইসব উদ্যোগ বাস্তব পরিসরের উদ্যোগেরই পরিপূরক ভাবনা থেকে গ্রহণ করা। এই চার তরুণ শিল্পী দৃশ্যমান নানা উদ্যোগ দ্বারাই উৎসাহিত হয়ে মূলত আত্মপ্রকাশ করেছেন নিজেদের শিল্পকর্ম নিয়ে। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনা একটি জটিল বিষয়। কিন্তু তারুণ্যের সংজ্ঞায় তাদের যে ভয় অথবা দোদুল্যমানতা তাদের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে, তা নজরুলের শনাক্ত করা অবয়ব সর্বস্ব তরুণদের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের সফলতার প্রকরণ হিসেবে এই ধরনের উদ্যোগ ইতিহাসের প্রামাণ্য হিসেবে নিঃসন্দেহে গুরুত্ব পায়। ১৯৮০-এর দশকে ‘সময়’ শিরোনামে যে গ্রুপের জন্ম তাদের রাজনৈতিক সময় ও তাদের বক্তব্যের স্পষ্টতা, দৃঢ়তা বর্তমান গ্রুপটির বিপরীতে একটি বৈপরীত্য নিয়ে হাজির হয়। যদিও সময় গ্রুপেরও নানা দ্বান্দ্বিক ও সাংঘর্ষিক অবস্থান রয়েছে। কিন্তু তা অন্য কোথাও আলোচনার বিষয়।
ভার্চ্যুয়াল স্পেসে প্রদর্শনী করার ক্ষেত্রে তাদের দর্শক ভাবনা কী ছিল? শিল্পীদের মতে, ‘ফেসবুক পেইজেও যে প্রমোট করতে হয়, এটা আমাদের ধারণা ছিল না। আমরা ভাবছিলাম এটা একটা উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, যেখানে প্রেস কনফারেন্স ডাকা লাগে না, মানুষ আসলে এমনিই দেখে। ফলে উন্মুক্ত করলেও এখানে ভিউয়ারস কারা হবে, এখানেও যে সীমাব্ধতা আছে, তা বুঝতে পারি নাই।’ শিল্পের ভাষা প্রসঙ্গে শাওন ও ধীামান জানান, ভার্চ্যুয়াল পরিসরের কথা ভেবে তারা যেভাবে ইমেজ তৈরি করেছেন, রিয়েল গ্যালারি স্পেসে হলে এভাবে করতেন না, হয়তো আরেকটু ওপেন বক্তব্য থাকত, এতটা প্রতীকী হতো না বা রঙের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতেন।
শিল্পের ভাষার ক্ষেত্রে সৈকত শিকদার ও অন্তরা দে ভিক্টোরীয় সৌন্দর্যে নির্মাণ করেছেন ব্যক্তিগত ক্লেদ বোধ, যে নির্মাণের ভাষা অনেক বেশি অন্যের ভাষায় নিজেদের পছন্দকে খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত। ধীমান তার বক্তব্যে শক্তিশালী, প্রচন্ড রাজনৈতিক অথচ যুক্ত হয়েছেন অন্তরা দে’র মতো শিল্পীর সাথে, যিনি ব্যক্তিগত পীড়ণকে শিল্পের ভাষায় প্রকাশ করতে চান, কিন্তু রাস্তায় মিছিলের মতো একটি সরাসরি বক্তব্যের সাথে শিল্পকে মিলাতে রাজি নন-যেমনটা হয়তো শাওনের কাজে প্রকাশ পেতে চায়। শাওন সেদিক থেকে তুলনামূলক স্পষ্ট যে, তার শিল্পকর্ম যদি পোস্টার হিসেবে খ্যাত হয়, তাহলেও তার কোনও আপত্তি নেই। তিনি তার বক্তব্যকে প্রকাশ করতে চান। তার ছবি সম্পর্কে কোনও ভাবনার দায় তিনি দর্শকের ওপর চাপাতে রাজি নন। তাই শিল্প ভাবনার সংকট প্রকাশ পায় যখন বলেন-পোস্টার ভাবনাটাকে নিজের ব্যর্র্থতা হিসেবেই দেখতে চান।
ফলে শিল্পের রাজনৈতিক চরিত্র কী হবে, শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ককে তারা কীভাবে দেখবেন-এই বিষয়ে তাদের ধারণা পরিষ্কার নয়। অথচ বক্তব্যে রাজনীতিই একটি মৌলিক ভাষ্য। দলহীন রাজনৈতিক পটভূমিতে দলবদ্ধ হওয়াটাই একটা রাজনীতি। আবার দলবদ্ধতার নামে পিন্ডীভূত হয়ে রাজনীতিকে অস্বীকার করাও মানিয়ে নেওয়ার রাজনীতি। ফলে তাদের এই দলীয় প্রদর্শনীটিকে কোনও একটি উদ্দীপনাময় তারুণ্যের সময়োপযোগী সাহসী উদ্যোগ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এটি পঞ্চাশের দশকের নাগরিক শিল্পচর্চাকারীর সংখ্যাবৃদ্ধির রাজনীতির অংশ এবং চলমান বৈশ্বিক মুক্তবাজার রাজনীতিতে, জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের ব্যারিকেডে বসে কোন অবস্থানটি সুবিধাজনক তা নির্ণয় করতে না পারার যে সর্বজনীন সংকট, তার আরও একটি নমুনা।
Please React...!