ঢাকা আর্ট সামিট ২০২০
এক.
সময়ের পরিক্রমায় দৃশ্য শিল্পে(ভিজ্যুয়াল আর্ট) যেসকল পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে তার ব্যাঞ্জনা নানাবিধ। শিল্পীর চিন্তাধারা তো বটেই শিল্পের ভাষা, শিল্পকর্মের মাধ্যম/উপকরণ, শিল্পকর্মের উপস্থাপন রীতির সাথে বদলে গিয়েছে শিল্প প্রদর্শনীর চিরায়ত ভঙ্গিমা। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে জাতি রাষ্ট্রের নামে সারা পৃথিবীর ভূখণ্ড ভাগ করে নেওয়া কতৃত্বশীল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শিল্পীর আকাঙ্ক্ষা ও সৃষ্টির সাথে বৃহদায়তন সমাজের সম্পর্কও বদলে গেছে ব্যাপকভাবে।
শিল্পচর্চার ধারা এখন যতটা না দক্ষতা ভিত্তিক তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক, শিল্পীর কর্ম সীমানা যতটা বিশেষায়িত তার চেয়ে বেশি সামগ্রিক। ধারণাপ্রধান(কন্সেপচুয়াল) কাজের এই নতুন বাস্তবতায় তৈরি হয়েছে নতুন নতুন শিল্প সম্পর্ক, পেশা এবং বাস্তবতা। বিশ্বায়নের ছাতার নিচে “আত্ম-পরিচয় সংকটের রাজনীতি ও মোকাবিলা” ভাবনার স্তরে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ব্যক্তি এবং সামষ্টিক “সত্তা” হিসেবে পরিচয়ের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী যেসকল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে শিল্পকলা তার মধ্যে অন্যতম।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের দৃশ্য শিল্পের যেসকল কর্মযজ্ঞ বিশ্ব শিল্পের দরবারে হাজির হচ্ছে “ঢাকা আর্ট সামিট” তার মধ্যে অন্যতম। ইতোমধ্যে তা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ শিল্পোৎসব হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। দ্বি-বার্ষিক ধারায় পরিচালিত এই প্রদর্শনীর ৫ম আসর অনুষ্ঠিত হল এবছর ফেব্রুয়ারি মাসের ৭-১৫ তারিখে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালা প্রাঙ্গণ এবং গ্যালারীতে বাংলাদেশসহ সর্বমোট ৪৫ টি দেশের ৫ শতাধিক শিল্পী, কিউরেটর, শিল্প সমালোচক, স্থপতি, শিল্প প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় এবারের আয়োজন। যেখানে পেইন্টিং, ভাস্কর্য, স্থাপনা শিল্প, পারফর্ম্যান্স আর্ট, ভিডিও আর্ট এর মত নানাবিধ মাধ্যমের শিল্পকর্ম স্থান পায় এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিম্পোজিয়ামসহ কয়েকটি সেমিনার এবং কিছু কর্মশালাও অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজনের অংশ হিসেবে।
“Seismic Movements” – “সঞ্চারণ” ছিল এবারের আয়োজনের মুল প্রতিপাদ্য। আয়োজকদের মতে- “Seismic Movements- ব্যাপক, বাহ্যিক ও খুবই দৃশ্যমান হয়ে থাকে; ফলত: ভূমি এবং শক্ত কাঠামোকে ঝাঁকুনি দেয় এবং সঞ্চারণ মাইক্রো ও ম্যাক্রো পর্যায়ে চলাচলের সূক্ষ্ম ও নিরবচ্ছিন্ন ক্রমঃপ্রবাহ তৈরি করে (কোন নির্দিষ্ট দিকে নয়)। সঞ্চারণকে ধরা/ধারণ করা যায় না এবং তা কখনোই সরলরৈখিক নয়। সঞ্চারণ দেহাভ্যন্তরে রক্ত বা আবেগের মধ্য দিয়ে প্রযুক্ত হতে পারে, অথবা বহিঃস্থ বাতাসের সাথে, অথবা ধারণা করা যায় যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বুদ্ধিমত্তার বিকাশের মাধ্যমে। এমনকি অনুবাদ প্রক্রিয়ার সময় যে স্নায়বিক সংযোগ তৈরি হয় সেটা আরেক ধরণের সঞ্চারণ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে দর্শনার্থীদের যাতায়াতও একপ্রকারের সঞ্চারণ, এভাবে ঢাকা আর্ট সামিটের আদর্শিক প্রক্রিয়াটি নির্মিত হয়েছে পাশাপাশি এর মূল ধারণাগুলি বিভিন্ন সংস্করণ জুড়ে বিকাশ লাভ করেছে।”
যে ৯টি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা/বিষয়কে ভিত্তি করে এই মুল ধারণা(Seismic Movement – সঞ্চারণ)-টি সংগঠিত হয়েছে তা হল- ভূ-তাত্ত্বিক আন্দোলন, উপনিবেশিক আন্দোলন, ব্যক্তিগত আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন ও নারীবাদী ভবিষ্যৎ, সামষ্টিক আন্দোলন, স্থানিক আন্দোলন, আধুনিক আন্দোলন, চলমান ছবি এবং সামদানি আর্ট এওয়ার্ড। সাথে মুজিব বর্ষের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জীবন ও কর্মের উপর ‘লাইটিং দি ফায়ার অব ফ্রিডম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী স্থান করে নেয় এই আয়োজনে। মূলত এই বিষয়গুলির মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমেই সম্পূর্ণ প্রদর্শনীটি রূপায়িত হয়।
প্রদর্শনীতে সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক ধারনার অংশ হিসেবে প্রত্যেকটি শিল্পকর্ম স্থান পেলেও তা বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়নি বরং প্রত্যেকটি বিষয়ের মধ্যে আন্তঃসংযোগের ধারা বজায় রাখতে শিল্পকর্মগুলিকে পাশাপাশি রেখেই উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন জাতীয় চিত্রশালার সামনের অংশ অর্থাৎ স্কাল্পচার গার্ডেনে বিখ্যাত শিল্পী ভারতী খের- এর “Intermediaries”- (চিত্র-১) শিরোনামের ভাস্কর্যটি এবং শিল্পী ডেমিয়েন ওর্তেগা-এর “Sisters; Hermanas (maquette)” (চিত্র-২) এর স্তূপ আকৃতির স্থাপনা শিল্প যথাক্রমে “সামাজিক আন্দোলন ও নারীবাদী ভবিষ্যৎ” এবং “সামষ্টিক আন্দোলন”- এর অংশ হিসেবে প্রদর্শনীতে স্থান পেলেও তা ব্যাবহারিক উপযোগিতা, কাজের গুরুত্ব ও স্থান বিবেচনায় কাজ দুটিকে পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে। শিল্পী রানা বেগমের “Reference image for No. 972 Wall Painting” (চিত্র- ৩) কাজটি নিচতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত সিঁড়ির দেয়ালে স্থান পেয়েছে।
অর্থাৎ প্রদর্শনীতে শিল্পকর্ম বিন্যাসের ক্ষেত্রে আয়োজকেরা ব্যবহার উপযোগিতার পাশাপাশি দৃশ্যগত সংযোগের সূত্রকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন বিশেষভাবে।
দুই.
চেকিং গেট পেরিয়ে সামনে এগোতেই পুরাতন মাটির দেয়াল এবং ছোট ছোট দরজা। ভেতরে পা রাখতেই জৈব ও অজৈব উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত সাইট স্পেসিফিক শিল্পকর্মটি “The Theater of Disappearance”-(চিত্র- ৪) পরিবর্তিত সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। শিল্পী আদ্রিয়ান ভিল্লার রোজাস প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের আবহে প্রকৃতি ও প্রানের সমপর্ক মনে করিয়ে দেন।
মেঘলা আকাশের নীচে বালুর স্তূপ। হটাত সেখানে মানুষের ভিড় দেখে এগিয়ে যেতেই দেখা গেল আগুনের লেলিহান শিখা উড়ছে এবং বালুর উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তরল ধাতব। তরল থেকে কঠিন অবস্থায় রূপান্তরের পর শিল্পী ও তার সহযোগীরা ধাতব দণ্ডগুলিকে বালুতে পুতে দেন। শিল্পী রাফায়েল হেফটির এই পারফর্মেটিভ ইন্সটলেশন “Quick Fix Remix”-(চিত্র- ৫) -এর মাধ্যমে দেখাতে চেষ্টা করেন নাগরিক মানুষ কিভাবে বস্তুর চরিত্রকে বদলে দেয় তার সীমা না জেনে। সভ্যতা নামক এই ব্যবস্থা কিভাবে প্রকৃতির সাধারণ প্রবাহকে ভিন্ন ধারায় ঠেলে দেয় সেটাই তিনি দেখাতে চেয়েছেন। দুটি কাজই ভু-তাত্ত্বিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
ঔপনিবেশিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে দুটি শিল্পকর্ম বিশ্বের দুই প্রান্তের জনগোষ্ঠীর ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতার জানান দিলেও সংকটের কেন্দ্রবিন্দু(ঔপনিবেশিক শাসন) একই হওয়ায় এর আবেদন অভিন্ন সুরে বাজতে থাকে দর্শকের মনে।
স্বাধীন রাষ্ট্রে উপনিবেশের মগজ-জাত শাসন ব্যবস্থা কিরূপে কাজ করে তা শিল্পী ঢালী আল মামুনের স্থাপনা শিল্প “Century’s Tale”- (চিত্র- ৬) চিত্রিত হয়। “চা” এবং “নীল” তাই শুধুমাত্র রঙের অনুষঙ্গ হয়ে থাকে না বরং তা বাংলার শাসনের ইতিহাসের সাথে বর্তমান সময়ের যোগসূত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়।
গ্রামোফোন রেকর্ডার এর আদলে উপস্থাপিত এই কাজে প্লাটারের উপর স্থাপন করা ড্রয়িং, এর চক্রাকারে ঘুর্নন প্রক্রিয়া এবং অবস্থান একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক শাসনের বলয় হিসেবে আমাদের সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নির্দেশ করে অপরদিকে এই সংকট মোকাবিলার উপায় হিসেবে ঘটনাটিকে উপর থেকে দেখবার ইঙ্গিত দেন।
আধুনিক সভ্যতার এই পর্যায়েও ঔপনিবেশিক শাসনের নির্মমতা কিরুপে বিদ্যমান তার দেখা মিলে জেসিয়া ম্যাকডেনিয়েল-এর “Only”- (চিত্র- ৭) সিরিজের কাজে। তার কাজের প্রেক্ষাপট হল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের পাঁচটি জনগোষ্ঠী যারা এখনো মার্কিন সেনাবাহিনীর কদর্য শক্তির পদতলে আমেরিকার উপনিবেশ হিসেবে শাসিত হচ্ছে। জেসিয়ার চিত্রকর্ম তার জন্য এক ধরনের নিরাময় পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে। সেক্সুয়াল ট্রমা আক্রান্ত নারীদের প্রতিকৃতি অংকনের মাধ্যমে তিনি নিজের সেক্সুয়াল ট্রমা থেকে নিরাময় লাভের চেষ্টা করেন।
সামাজিক আন্দোলন ও নারীবাদী ভবিষ্যৎ প্রকল্পের অংশ হিসেবে শিল্পী নীলিমা শেখ- এর “Beyond Loss”- (চিত্র-৮) শিরোনামের কাজটি প্রণিধানযোগ্য। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে কাশ্মীরে চলা দমন, নিপীড়নের গল্প উঠে এসেছে তার চিত্রপটে। বিশেষ করে তার আখ্যানধর্মী ল্যান্ডস্কেপে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নারী সত্তার সাথে ঘটে যাওয়া বৈষম্যগুলো চিত্রায়িত হয় সুনিপুনভাবে। অংকন শৈলীর ক্ষেত্রে তিনি দক্ষিণ এশীয় রেখার সাথে চাইনিজ দেয়াল চিত্র ও জাপানিজ স্ক্রল চিত্রের সমন্বয় ঘটান।
দলবদ্ধ বা সামষ্টিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশ-বিদেশের অসংখ্য সংগঠন অংশ নেয় এই আয়োজনে। বাংলাদেশের শনি-মঙ্গল আড্ডা, জোগ আর্ট স্পেস, আর্টপ্রো, ব্যাক আর্ট, উড়ন্ত, গিদরি বাউলি, বৃত্ত, আকালিকো, হিল আর্টিস্ট গ্রুপ, যথাশিল্পসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন অংশ নেয়। দেশের বাইরের সংগঠন হিসেবে ফ্রান্সের “আমান আইয়ান”, ইন্দোনেশিয়ার “রংরুপা”, নেপালের “আর্ট ট্রি”, ভিয়তনামের “আর্ট লেবার” মেক্সিকোর “কালপুল্লি টিকালকো” নামক সংগঠন অংশ নেয়। ভিন্ন ভিন্ন কিউরেটরের অধীনে এইসকল শিল্প সংগঠনগুলো তাদের নিজ নিজ প্রকল্প নিয়ে হাজির হন।
শনি-মঙ্গল আড্ডা ঢাকা আর্ট সামিটে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে প্রতিদিন সাইনবোর্ডে দর্শকদের উদ্দেশে শিল্পকলা, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক একটি করে প্রশ্ন উত্থাপন করে যা দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই প্লাটফর্মে বাংলাদেশি তাত্ত্বিক রক মনু, সামসুদ্দোজা সাজেন দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনায় অংশ নেন। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ান লেখক ও শিল্পী আলানা হান্ট ভারতের কাশ্মীরে কাটানো তার অভিজ্ঞতা নিয়ে দর্শকদের সাথে একটি কথোপকথনে অংশগ্রহণ করেন এবং নেপালের “কাঠমান্ডু ট্রায়ানাল”-এর আয়োজকেরা তাদের পরবর্তী সংস্করণের ঘোষণা দেন একই প্লাটফর্ম থেকে। আর্টপ্রো তাদের প্রকল্পে বাংলাদেশের ষড়ঋতু চিত্রিত করে এদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশী কাঁথায়। আমাদের ঐতিহ্যের আরেকটি অংশ পুতুল নাচ প্রদর্শিত হয় ব্যাক আর্টের প্রকল্পে। ইন্দোনেশিয়ার সংগঠন রংরুপা “Collectivity and Economy” শিরোনামে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সংগঠনগুলির মুখপাত্রদের সমন্বয়ে একটি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে আশির দশকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এসময়ের রাজনৈতিক বাক বদলের সাথে শিল্পী-সাহিত্যিকদের ভূমিকা তুলে ধরতে কিউরেটর মুস্তাফা জামান “Nobody Told Me There Would be Days Like These” শিরোনামে একটি গবেষণাধর্মী প্রকল্প সাজিয়েছিলেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একদল শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় আশির দশকের শিল্প-সাহিত্য, থিয়েটার, স্থাপত্য এবং দৃশ্য শিল্প চর্চায় একটি নতুন ধারার জন্ম হয় যা পরবর্তী চর্চাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষত দৃশ্য শিল্পে “সময়” নামে আত্মপ্রকাশ করা একদল শিল্পীর কর্মকাণ্ড, যারা অন্ধভাবে পশ্চিমা শিল্পের নির্বস্তক চর্চা অনুসরণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে শিল্পে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্যের পাশাপাশি স্থানিক বাস্তবতার প্রতিফলন খুঁজতে উদ্যত হয়েছিলেন। ঢালী আল মামুন, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, হাবিবুর রহমান, তৌফিকুর রহমান, ওয়াকিলুর রহমান, দিলারা বেগম জলি, আজিজ শরাফী, সাইদুল হক জুইস, আলী মোর্শেদ নোটন, লালারুখ সেলিম ছিলেন সেই গ্রুপের সদস্য। জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান, কামরুল হাসান- এর শিল্পভাষাকেও তারা অনুপ্রেরনা হিসেবে নিয়েছিলেন।
এবছর সামদানি আর্ট এওয়ার্ডের জন্য ১২ জন বাংলাদেশি শিল্পী মনোনীত হন। কিউরেটর ফিলিপ্পে পিরত্তে- এর তত্ত্বাবধানে এবং সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় এই ১২ জন শিল্পী তাদের নিজ নিজ প্রকল্প উপস্থাপন করেন। ডেলফিনা ফাউন্ডেশনের পরিচালক এরন সিজার- এর সভাপতিত্বে শিল্পী আদ্রিয়ান ভিলার রোজাস, শিল্পী জুলি মেহরিতু, কিউরেটর ইউজি জু, ক্রিশ্চভ বাকারগিভ এর সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক জুরি কমিটি শিল্পী সোমা সুরভী জান্নাত কে তার “Into the Yarn, Out in the One” (চিত্র-৯) প্রকল্পের জন্য সামদানি আর্ট এওয়ার্ড-২০২০ এর সম্মাননা প্রদান করেন।
শিল্পী সোমা সুরভী জান্নাত-এর কাজের বিষয় প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক। সভ্যতার বিভিন্ন স্তরে এই সম্পর্কের যে বিবর্তন সেটি যেমন তিনি খুঁজতে চেয়েছেন তেমনি সমকালীন বাস্তবতায় এই সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন নিজ সত্তার অস্তিত্বকে। ল্যান্ডস্কেপ তার বাস্তবতা উপলব্ধির এক অন্যতম মানদণ্ড আর ভিন্ন ভিন্ন ল্যান্ডস্কেপে নিজের অভিজ্ঞতাকে তিনি ড্রয়িং এর মাধ্যমে ধারণ করতে চেয়েছেন। অনুভূতি ব্যক্ত করতে ভিন্ন ভিন্ন ল্যান্ডস্কেপ এর মেটাফোর হিসেবে বেছে নিয়েছেন উঁচু-নিচু প্লাই উডের পাটাতন। যার উপর স্বতঃস্ফূর্ত অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত সেই ড্রয়িংগুলো উপস্থাপন করেন। প্রদর্শনী কক্ষে এই স্থাপনাটির গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের কারণে দর্শক খুব সাবলীলভাবে একদিক থেকে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যেতে উদ্যত হয়। আর পথিমধ্যে এই স্থাপনার সাথে দর্শকের যে কথোপকথন তা পক্ষান্তরে শিল্পীর অভিজ্ঞতার সাথে দর্শকের অভিজ্ঞতার সংযোগ তৈরি করে।
তিন.
স্থানিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে “শিকড়” শিরোনামে কিউরেটর বিশ্বজিৎ গোস্বামীর প্রকল্পটি দর্শকদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ তৈরি করেছিল। যেখানে তিনি বাংলাদেশের শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান(বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের)-গুলিকে এদেশের দৃশ্য শিল্পের শেকড় হিসেবে চিহ্নিত করেন। এক্ষেত্রে দৃশ্যরূপ হিসেবে তিনি যা হাজির করেছেন সেখানে বাংলাদেশের শিল্পকলায় ঐসকল প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি(বিশেষত শিক্ষক) শিল্পীদের অবদান যতটা, যেভাবে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ততটা আসেনি। অর্থাৎ সামষ্টিক বিবেচনায় বাংলাদেশের শিল্পকলায় এই সকল প্রতিষ্ঠানসমুহ কোন কোন ক্ষেত্রে ঠিক কি ধরনের অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ফলত: এরকম প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, আদৌ এদেশের শিল্পচর্চার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে ঐসকল প্রতিষ্ঠানগুলির সুনির্দিষ্ট কোন অবদান আছে কি? এই প্রতিষ্ঠানগুলি দৃশ্য শিল্পের বলয়ে তাদের নিজস্ব কোন চরিত্র নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে?
যেকোনো শিল্পকর্ম সম্যক উপলব্ধির ক্ষেত্রে সেটির উপস্থাপন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বর্তমান সময়ে যখন কিনা শিল্পীরা তাদের ভাষা প্রকাশের ক্ষেত্রে যৌক্তিকতার মানদণ্ডে যেকোনো বস্তুকে শিল্পকর্মের উপাদান হিসেবে বেছে নেন। এক্ষেত্রে একটি শিল্পকর্মের গাঠনিক ব্যাপ্তি এবং তার সাথে দর্শকের যোগাযোগের ক্ষেত্রে আয়োজকদের অনেক বেশি সচেতন হতে হয়। তা না হলে এধরনের বৃহৎ আয়োজনের মধ্যে কোন কোন শিল্পকর্ম যেমন বেশি গুরুত্ব পায় তেমনি কোন কোন শিল্পকর্ম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। যা এবারের ঢাকা আর্ট সামিটে বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। ফলে একদিকে দর্শক যেমন বিভ্রান্ত হয়েছে অন্যদিকে ঐসকল শিল্পকর্মগুলি গুরুত্ব হারিয়েছে বহুলাংশে। আবার একই সময়ে একই স্থানে জোরালো শব্দ সংযোগে কয়েকটি প্রোগ্রাম সংঘটিত হয়েছে যা শেষ পর্যন্ত দর্শকদেরকে নির্দিষ্ট করে কোন একটিতে মনোনিবেশ করতে দেয়নি। এক্ষেত্রে আয়োজকদের এই ত্রুটি ছিল চোখে পড়ার মত। এরকম বৃহৎ পরিসরের কর্মযজ্ঞে এধরনের অব্যবস্থাপনা শিল্পী এবং দর্শকদের হতাশ করেছে।
চার.
ঢাকা আর্ট সামিটের এবারের আয়োজনে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শকের দেখা মিলেছে। শুধু তাই ই নয় বাংলাদেশের দৃশ্য শিল্পের যেকোনো ইভেন্টে বিপুল পরিমাণ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ইতোপূর্বে আর দেখা যায়নি। লাইভ পারফরম্যান্স এবং ইন্টার্যাক্টিভ শিল্পকর্মের চারপাশে দর্শকের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। শিল্পকর্মের সাথে সাধারণ দর্শকের যোগাযোগ তৈরি করতে গত বারের ন্যায় এবারও ছিল শিল্প মধ্যস্থতাকারী(Art Mediator) নামক একটা গ্রুপ। যারা কৌতূহলী দর্শকদের শিল্পকর্ম সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, সহায়তা করেছেন প্রদর্শনী উপভোগ করতে।
নাগরিক জীবনে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা মানুষেরা তাদের এক টুকরো অবসর কাটিয়েছেন শিল্পীর সাথে আলাপচারিতায়, শিল্পকর্ম উপভোগ করে, স্মৃতি ধরে রাখতে শিল্পী এবং শিল্পকর্মের সাথে সেল্ফি তুলে। মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এদেশের দৃশ্য শিল্পের সকল শ্রেনীর অংশীদারের জন্য যেমন আশাব্যঞ্জক তেমনি আয়োজকদের জন্যেও প্রেরণাদায়ক। এ পর্যন্ত দৃশ্য শিল্পের বৈশ্বিক বলয়ে “মঙ্গল শোভাযাত্রা” ব্যতীত আমাদের অন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড স্ব-মহিমায় স্থান করে নিতে পারেনি। এমনকি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে আয়োজন করে গেলেও খোদ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যেও বাংলাদেশের শিল্পকলার কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়নি। ফলত: কনসেপচুয়াল আর্টের যে ব্যাপকতা সেখানে এখন পর্যন্ত আশার আলো হয়ে আসছে ঢাকা আর্ট সামিটের মত এইসব কার্যক্রম।
মোঃ বজলুর রশিদ শাওন
লেখকঃ ঢাকা আর্ট সামিট-২০২০ এ অংশগ্রহণকারী সংগঠন “শনি-মঙ্গল আড্ডা”-র একজন সদস্য
Please React...!